স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ঢাকা।। বাতায়ন ২৪ডটকম।।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের অবসান ঘটে। ঝিমিয়ে থাকা দুর্নীতি দমন কমিশনও সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে জাগ্রত হয়। শেখ হাসিনার পতনের দুই সপ্তাহের ব্যবধানে একের পর এক ‘হাইপ্রোফাইল’ রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানের আওতায় আনা শুরু করে সংস্থাটি। এরই মধ্যে বছর পার হয়ে গেছে। এক বছরে সংস্থাটির দুই কমিশন মিলে মামলা দায়ের করেছে ৪শ’টির বেশি। আসামি করা হয়েছে ১২শ’র বেশি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তড়িঘড়ি করে অনুসন্ধান শেষ করে মামলায় গিয়ে সে মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েও রয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। দুদকের অনেক মামলায় আসামি ফাঁকফোঁকরে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যয়।
গত বছরের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং ৮ই আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দুদক দৃশ্যমানভাবে সক্রিয় হতে শুরু করে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রথম তিন মাস দুদকের নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। ২০২৪ সালের ২৯শে অক্টোবর তিনি ও কমিশনের অন্য সদস্যরা পদত্যাগ করলে প্রায় দেড় মাস পরে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বে একটি নতুন কমিশন দুদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
৫ই আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত দুটি কমিশন মিলিয়ে মোট ৭৬৮টি অভিযোগ প্রাথমিক অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৩৯৯টি মামলা দায়ের, ২৩১টি অভিযোগপত্র দাখিল ও ৯টি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। কমিশন ২২৩টি সম্পদ বিবরণী জমার নোটিশও দিয়েছে। ড. মোমেন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর এ বছরের জানুয়ারিতে একক মাসে সর্বোচ্চ ৭০টি মামলা হয়েছে।
মামলাগুলোতে ১ হাজার ২৬৪ জন আসামির মধ্যে ২৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা, ১১৪ জন ব্যবসায়ী, ৯২ জন রাজনীতিবিদ, ৪৪৭ জন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং ৩১ জন জনপ্রতিনিধি। অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, রেহানার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তি ও টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক। তালিকায় আরও রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, মামলাগুলোর মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, বৃহৎ সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি, অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ ও বৈধ আয়ের বাইরে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারে কারচুপি ও অবৈধভাবে জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড ও কানাডায় বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করার অভিযোগও রয়েছে।
অভিযোগও রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড ও কানাডায় বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করার অভিযোগও রয়েছে।
তিনি আরও জানান, অনেকের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে কারসাজি, বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে।
দুদক জানায়, গত ১১ মাসে দুদকে মোট ১২ হাজার ৮২৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে শুধু গত বছরের নভেম্বরে জমা পড়েছে ৩ হাজার ৪০৬টি। দুদক চেয়ারম্যানের দপ্তর ও অন্য দপ্তর থেকে পাওয়া প্রায় ৩ হাজার ৫০০টি অভিযোগ নিয়েও কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এক বছরে নেই ফাঁদ অভিযান: দেশের সেবাপ্রদানকারী অফিসগুলোতে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী সংস্থা দুদক ঘুষখোরদের ধরতে পারছে না। দুদক ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতেনাতে ধরতে ফাঁদ-অভিযান (স্টিং অপারেশন) পরিচালনা করে থাকে। অদৃশ্য কারণে এখন এ ধরনের অভিযান বন্ধ রয়েছে। ২০২৪ সালে একটি ফাঁদ মামলাও করতে পারেনি সংস্থাটি। তবে ওই সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের অভিযান চলেছে। দুদকের তথ্যমতে, হাতেনাতে ঘুষখোরদের ধরার বেশ কার্যকর একটি কৌশল হচ্ছে ফাঁদ মামলা। অবশ্য ২০২৪ সালে একটি ফাঁদ অভিযান হয়নি। এর আগের বছর হয়েছিল ৩টি, ২০২২ সালে ৪টি, ২০২১ সালে ৬টি, ২০২০ সালে ১৮টি, ২০১৯ সালে ১৬টি ও ২০১৮ সালে ১৫টি। দুদকে কয়েকটি উৎস থেকে দুর্নীতির অভিযোগ আসে। ভুক্তভোগী বা যেকোনো ব্যক্তি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ও ৩৬ জেলা কার্যালয়ে সরাসরি অভিযোগ করতে পারেন। ই-মেইল ও ডাকযোগে অভিযোগ পাঠানোর ব্যবস্থাও আছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদকে দুদক অভিযোগের উৎস হিসেবে আমলে নেয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিবেদন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন, আদালত থেকে পাঠানো পিটিশন কিংবা সিআর মামলা দুদকে অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়। যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এসবের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।
মামলা নিয়ে অনিশ্চয়তা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া দুদক এক বছরেই ৪শর’ বেশি মামলা দায়ের করেছে। এরমধ্যে উল্লেখ করার মতো অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছে কেবল একটিমাত্র মামলায়। শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজউকের প্লট জালিয়াতির মামলাটিতেই দুদক চার্জশিট দিতে পেরেছে। তা ছাড়া অন্য কোনো বড় মামলা কুল-কিনারা হয়নি। তবে বিদ্যুৎগতিতে মামলা হওয়া নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন দুদকের সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দুদকের কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, যেভাবে মামলা করা হয়েছে সেগুলোর তদন্ত শেষ করা সহজ হবে না। অনেক মামলার তদন্তই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হচ্ছে না। হওয়ার কথাও না। সাধারণত দুদকের মামলা করা হয় যা অনুসন্ধানকালেই পর্যাপ্ত প্রমাণাদি নিয়ে। কিন্তু ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে যেসব মামলা করা হয়েছে তার বেশির ভাগই পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। তদন্তকালে তদন্ত কর্মকর্তারা এ ধরনের মামলা নিয়ে হিমশিম খান। তাই এসব মামলায় বিচার হওয়া নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়ে যায়।
দুদকের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, মামলার আগে সাধারণত সব ধরনের তথ্য উপাত্ত নেয়া উচিত। এখন অনেক মামলারই পর্যাপ্ত তথ্য নেই। যা তদন্তকালে সংগ্রহ করতে হয়। বিশেষ করে এক এমপির মামলার অভিজ্ঞতা বলি, তার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র হলফনামার তথ্য সংগ্রহ করেই মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত করার সময় আবার নতুন করে সম্পদের নোটিশ জারি করা লাগবে। তার অবৈধ সম্পদ ধরে নতুন করে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা ছাড়া এই মামলায় যেনতেন চার্জশিট দিলে আদালতে গিয়ে আইনের ফাঁকফোঁকরে বেরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।
বাতায়ন২৪ডটকম/শরিফুল ইসলাম।