স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ঢাকা।। বাতায়ন২৪ডটকম।।
লালন সংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীন সারা জনমের জন্য উপরে চলে গেলেন।
জাগতিক সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি পাড়ি দিয়েছেন অচিন দেশে।
শনিবার রাজধানীর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত সোয়া ১০টায় তার মৃত্যুর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।
ফরিদা পারভীনের মৃত্যুর খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, “রাত ১০টা ১৫ মিনিটে হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ফরিদা পারভীন।“
সবশেষ গত ২ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ফরিদা পারভীনকে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার পরই নিয়ে যাওয়া হয় আইসিইউতে। পরে তাকে লাইফ সাপোর্টেও নেওয়া হয়; সেখান থেকে আর তাকে ফেরানো যায়নি।
ফরিদা পারভীন বেশ কিছু ধরে অসুস্থ ছিলেন। কিডনি সমস্যা ও ডায়াবেটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। কিডনি ডায়ালাইসিস চলছিল সপ্তাহে দুদিন করে। তবে মাঝেমধ্যে অবস্থার অবনতি হত তার। চলতি বছরে তিন দফায় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে তাকে।
সবশেষ হাসপাতালে ভর্তি করার পর তার চিকিৎসায় ছয় সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল।
শনিবার রাতে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী বলেন, “ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। সম্প্রতি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে উনাকে সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস করাতে হত। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে গত ২ সেপ্টেম্বর আমাদের হাসপাতালে আনা হয় তাকে। ডায়ালাইসিসের পর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন।
“এরপর থেকে তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বুধবার অবস্থার অবনতি হলে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বুধবার থেকে তিনি ভেন্টিলেশনে ছিলেন।”
ফরিদা পারভীনের শারীরিক অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়ার সুযোগও নেই।
তিনি বলেছিলেন, “ফরিদা পারভীনের রক্তচাপ কিছুটা বেড়েছে, তবে তার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অনেক কম, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি এবং জ্ঞানের স্তরও নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
“উনি বর্তমানে মাল্টি-অর্গান ফেইলিওরের রোগী। গতকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে ডায়ালাইসিস দেওয়ার চেষ্টা চলছে, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।”
এবারের আগে এই হাসপাতালেই গেল ৫ জুলাই ভর্তি হন ফরিদা পারভীন। সেবারও আইসিইউতে রাখা হয়। টানা দুই সপ্তাহ তখন হাসপাতালে ছিলেন তিনি। বাড়ি ফিরে চিকিৎসকের বেঁধে দেওয়া নিয়মের বেড়াজালে দিন কাটছিল তার। এরও আগে ফেব্রুয়ারিতে শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে ১৩ দিন হাসপাতালে ছিলেন এই শিল্পী।
ফরিদা পারভীনের উন্নত চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
তার বড় ছেলে ইমাম নিমেরী গ্লিটজকে বলেছিলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে তার মায়ের চিকিৎসার ‘সব খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছে না’।
তিনি বলেছিলেন, “ফরিদা পারভীনের আর্থিক ক্রাইসিস না থাকলে তো তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হত, অন্য বড় হাসপাতালে নেওয়া হত। বারবার ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় কেন এই কারণ তো জানতে চায় না কেউ। সরকার থেকে উনাকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করানো হোক এটা আমার চাওয়া।”
জুলাইয়ে ফরিদা পারভীনকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে এ বিষয়ে তাগিদ দেন। প্রয়োজনে বিদেশে নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেন বিএনপির নেই নেতা।
তারপর ফরিদা পারভীনের চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া তখন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ফরিদা পারভীনের চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছিলেন।
লালনের গানের ‘রানি বা সম্রাজ্ঞী’ উপাধি তার পছন্দ ছিল না
নানা রোগ সয়েও লালন চর্চায় নিবেদিত ছিলেন তিনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালন চর্চা ছড়িয়ে দিতে প্রায় ১৬ বছর আগে ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করা ‘অচিন পাখি সংগীত একাডেমি’তে প্রায়ই যেতেন ফরিদা পারভীন। শিক্ষার্থীদের সামনে বসিয়ে তালিম দিতেন। তাদের শোনাতেন লালনের তত্ত্ব কথা। তার চাওয়া ছিল লালনের গান বেঁচে থাকুক সংগীতের এই পাঠশালার মাধ্যমে।
কিন্তু ফরিদা পারভীনের শারীরিক অসুস্থতা, প্রতিষ্ঠানের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়া এবং নিজস্ব ভবন না থাকায় এ প্রতিষ্ঠানটিও ধুকছে টিকে থাকার লড়াইয়ে।

লালনের গান গেয়ে ফরিদা কেবল নিজেই জনপ্রিয় হননি, এই সংগীতকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পৌঁছে দিয়েছেন। সংগীতের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে পেয়েছেন একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা।
১৯৫৪ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর নাটোরে জন্ম নেওয়া ফরিদা বেড়ে ওঠেন কুষ্টিয়ায়। বাবা ছিলেন চিকিৎসক, মা গৃহিনী। সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়া ফরিদার গানে হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সে। বাবা-মায়ের উৎসাহে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়া ফরিদার ইচ্ছা ছিল নজরুলসংগীতের শিল্পী হওয়ার। এগোচ্ছিলেনও সেই পথেই।
রাজশাহী বেতারে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন ১৯৬৮ সালে। গেয়েছেন আধুনিক ও দেশের গানও। তরুণ বয়সে লালনের গান একরকম ‘উপেক্ষিতই’ ছিল তার কাছে। তবে সংগীতের অন্য সব ধারাকে পাশে সরিয়ে কীভাবে, কোন তাড়নায় তিনি লালনের গানে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন সেই গল্প ফরিদা শুনিয়েছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে।
ফরিদা বলেছিলেন, স্বাধীনতার বছরখানের পর কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসবে গুরু মোকছেদ আলী তাকে তাকে অনুরোধ করেছিলেন লালনের গান গাইতে।
বাতায়ন ২৪ডটকম/শরিফুল ইসলাম।