বিদ্যালয়ের অপ্রতুলতা, শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, অভিভাবকদের দারিদ্র্য ও অনীহা-সব মিলিয়ে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষার পথ এখনো বন্ধুর। শিক্ষার আলোর পরিবর্তে সেখানে ছড়িয়ে আছে অন্ধকার বাস্তবতা। ফলে বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রম ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এই প্রত্যন্ত জনপদে।
কুড়িগ্রামের চিলমারীর চরাঞ্চলে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। কেউ কৃষিক্ষেত্রে কাজ করতে ছুটে যায়, কেউবা নৌকা করে শহরের দিকে। ঘরের নারী ও কিশোরীরা গৃহস্থালির পাশাপাশি কৃষিকাজেও হাত লাগায়। শিশুদেরও দেখা যায় ছোটখাটো কাজে সহায়তা করতে। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা ছিল বই-খাতা, সে বয়সেই তারা হাতে নিচ্ছে কোদাল বা পানির বালতি। শিক্ষা নিয়ে উদাসীনতা যেন এখানে প্রাত্যহিক জীবনের অংশ।
চিলমারী চরের সাহেরা বানু বাতায়ন২৪ডটকমকে বলেন, “মেয়েকে পড়বার ইচ্ছা থাকলেও হামার সামর্থ্য নাই। এতদিন মাদ্রাসাত পড়ছিল। বন্যার ভাঙাভাঙির জন্য সেই মাদ্রাসাও নাই। এালা বেটি বাড়িত বসি আছে। এখন পাত্র দেখছি বিয়ে দেয়ার জন্য।”
একই গ্রামের আনেস আলী জানান, “প্রাইমারি স্কুলে সোগে ফ্রি পাছি। কিন্তু কড়াইবাড়ি হাই স্কুলে বই-খাতা, কোচিং, বেতন—সবই টাকায় করতে হয়। সোগকিছু সামর্থ্যের বাইরোত। আবার বেটি ছাওয়াক বাইর পাঠাইতেও ভয় লাগে। এইজন্য ইচ্ছা থাকলেও বেটিক পড়বার পাইতাছি না।”
বগুড়াপাড়া চরের আব্দুস সালাম বাতায়ন২৪ডটকমকে বলেন, “মোর বড় বেটির বয়স ১৪ বছর। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়া বসে আছে। মানুষ অনেক কথা কইতেছে, তাই এখন বিয়ে দিতে হইব। ছোট বেটিটাও পড়তেছে, খুব ইচ্ছা পুলিশ হইব। কিন্তু এখানে হাই স্কুল নাই, কলেজ নাই। নদী পার হয়ে দূর যাইতে হয়। কেমন করিয়া পড়াশোনা করাবো?”
কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলার ২০০টিরও বেশি চরের মধ্যে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয় আছে মাত্র ৪টি। এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৩টি, ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয় ৬টি, নিম্ন মাধ্যমিক ৯টি। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ আছে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানে। পুরো এলাকায় কলেজ মাত্র তিনটি।
চরবাসীর অভিযোগ, শিক্ষকের ঘন ঘন অনুপস্থিতি এবং বিদ্যালয়ের অপ্রতুলতা শিশুদের স্কুল থেকে বিমুখ করছে। চর এলাকার মুদি দোকানদার মোহাম্মদ আলী বলেন, “কড়াইশিল বাড়ি হাই স্কুলে এইট পর্যন্ত পড়ায়। ক্লাস টেন পর্যন্ত কোচিং চলে, তাতেই অনেক টাকা লাগে। আবার পরীক্ষা দিতে হয় নদী পার হয়ে সদরে। মেয়েদের পক্ষে এটা অসম্ভব। যদি চরেই পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতো, অনেক মেয়ে অন্তত এসএসসি পাশ করতে পারতো।”
কুড়িগ্রামের লাইট হাউস এনজিওর চিলমারী চরের ইউসি হামিদা আক্তার বাতায়ন২৪ডটকমকে বলেন, “এখানে প্রাইমারিতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পেলেও মাধ্যমিকে এসে ঝরে পড়ছে। এখানে মেয়েদের ইচ্ছে থাকলেও মাধ্যমিকে পড়তে পারছে না। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেলেও নবম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য তাদেরকে নৌকায় করে অনেক দূরে যেতে হয়। অভিভাবকরা সেজন্য মেয়েদের পড়াতে চায়না। চিলমারীতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পেলে এখানকার শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।”
কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার শফিকুল ইসলাম বাতায়ন২৪ডটকমকে বলেন, “দারিদ্র্য, যাতায়াত ব্যবস্থার দুরবস্থা ও অভিভাবকদের উদাসীনতার কারণে চরের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেশি। তবে শিক্ষকদের মাধ্যমে আমরা ক্রমাগত সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছি। আগের তুলনায় শিক্ষার মান কিছুটা উন্নত হয়েছে।”
চিলমারীসহ কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে এখনো শিক্ষার আলো পুরোপুরি পৌঁছায়নি। বিদ্যালয়ের স্বল্পতা, যাতায়াতের দুর্ভোগ, এবং সামাজিক কুসংস্কার মিলে এখানকার শিশুরা বইয়ের পাতা থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। শিক্ষা তাদের কাছে এখনো এক অনতিক্রম্য স্বপ্ন।