রংপুর প্রতিনিধি, বাতায়ন২৪ডটকম
প্রবাসে যেতে অনাগ্রহ, দক্ষ জনশক্তির অভাব ও বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি না থাকায় দিন দিন বিদেশে কর্মসংস্থানে পিছিয়ে পড়ছে রংপুর। তারপরও যারা নিজ উদ্যোগ আর আগ্রহে বিদেশমুখী হতে হচ্ছে, তাদের অনেকেই আবার দালালের খপ্পরে পড়ে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। এ পরিস্থিতিতে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে রংপুর যেমন পিছিয়ে পড়ছে তেমনি রেমিটেন্সেও তলানিতে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে আগ্রহ ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রচারণা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দালালের দৌরাত্ম্য ও এজেন্সির অনিয়ম ঠেকাতে দিচ্ছেন ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস। বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের দক্ষতা বাড়িয়ে তাদের নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে নানামুখী কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস সূত্র জানিয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রংপুরের ৮ উপজেলা থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে ৩৩ হাজার ১০৪ জন। যা সারা দেশের তুলনায় শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ সময় গোটা দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে ৯৫ লাখ ৬২ হাজার ৭১৬ জন।
২০০৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১৮ বছরে রংপুর জেলা থেকে সাড়ে ৩৭ হাজার শ্রমিক অভিবাসী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ২০০৪ থেকে ২০১০ সালে বিদেশে গেছেন ৮ হাজার ৩৩ জন এবং ২০১১ থেকে ২০২২ সালে গেছেন ২৩ হাজার ৫৮৬ জন।
করোনার সময় ২০২০ সালে মাত্র ৪৭৩ জন অভিবাসী শ্রমিক রংপুর থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। করোনা মহামারির সময় অভিবাসী শ্রমিকরা ঘরমুখী হলেও এখন নতুন করে বিদেশমুখী হতে শুরু করেছেন। ২০২১ সালে ১ হাজার ৬২২ জন আর ২০২২ সালে ৩ হাজার ৮৬৯ জন শ্রমিক গেছেন বিদেশে।
এদিকে আগে রংপুর থেকে বিদেশগামী অভিবাসীর সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের সুবাদে এখন রংপুর জেলা থেকে প্রবাসীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জেলার মধ্যে মিঠাপুকুর উপজেলা প্রবাসীর দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আর পিছিয়ে রয়েছে তারাগঞ্জ উপজেলা।
২০২৩ সালে দুবাইয়ের একটি পাঁচ তারকা হোটেলে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার জন্য স্থানীয় এক দালালের সঙ্গে ৪ লাখ টাকায় চুক্তি হয় রংপুর মিঠাপুকুর উপজেলার ঈসমাইল হোসাইনের। তবে কয়েক দফায় হাত বদল হয়ে টুরিস্ট ভিসায় তিনি দুবাই পৌঁছালেও মেলেনি কোনো কাজ। পরে আত্মীয়দের সহায়তায় দুই মাস পর দেশে ফেরেন ঈসমাইল।
তিনি বলেন, ‘দুবাইয়ে যাওয়ার পর খাওয়ার টাকা ছিল না। ক্ষুধায় কান্নাকাটি করতাম। তখন প্রবাসীরা কিছু অর্থ দিলে খেতে পারতাম।’
একইভাবে মালেশিয়া যেতে তিন ভাই মিলে দালালকে ৯ লাখ টাকা দিয়েছিলেন ওই এলাকার আশরাফুল। তবে বিদেশ যাওয়া তো দূরের কথা, কষ্টের টাকাও ফেরত পাননি তারা। ভুক্তভোগী আশরাফুল বলেন, ‘টাকা দেওয়ার পর বিভিন্নভাবে ঘুরাতে থাকে দালালচক্র। দেখা করার জন্য নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া হয়। সেই তারিখ আসলে দেওয়া হয় আরেক তারিখ।’
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রংপুর বিভাগে রেমিটেন্স এসেছে ৬৮৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০১ দশমিক ০৩ মিলিয়নে। আর চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে এর পরিমাণ ১৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০২৩ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় একটি চীনা কোম্পানিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমান পীরগাছার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের সাকিব খান শুভ। সরকারি সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মালয়েশিয়ায় গমন করে দেড় বছর ধরে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন শুভ। সম্প্রতি প্রবাসী এই রেমিটেন্সযোদ্ধা বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে প্রবাসীদের অবদান এবং রেমিটেন্সে পিছিয়ে পড়া রংপুরকে এগিয়ে নিতে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করা উচিত। এক্ষেত্রে বিদেশগমনে আগ্রহ বাড়াতে প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ, তথ্য ঘাটতি ও দালালদের দৌরাত্ম্য দূর করা গেলে রেমিটেন্স বাড়বে বলে মনে করছেন এই তরুণ প্রবাসী।
গত বছর রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর হাজীপাড়া থেকে সৌদি আরবে গেছেন তুহিন ও হাবিব নামে দুইজন কোরআনের হাফেজ। মাদরাসা থেকে কোরআন হেফজ শেষ করে তারা প্রথমে ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে নিজেদের প্রশিক্ষণ দেন। পরে সরকারি প্রশিক্ষণ নিয়ে সৌদি আরবে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে পাড়ি জমান। বর্তমানে সেখানে তারা ভালো রয়েছেন এবং নিয়মিত উপার্জিত অর্থ দেশে পাটাচ্ছেন বলে জানান তাদের পরিবার।
সৌদি প্রবাসী তুহিনের বাবা ওয়াহেদুল ইসলাম বলেন, রংপুরের মানুষ অনেক আগে থেকেই বিদেশ যাওয়া নিয়ে আগ্রহী ছিল না। তবে এখন অনেকের কাছে শুনে ও খবর নিয়ে যাচ্ছে। কারণ সুযোগ-সুবিধা ভালো। আমরা দেশে যে শ্রম দিই, সেই তুলনায় মূল্য পাই না। তবে বিদেশে শ্রমের মূল্য ভালো। তাই আমার আট ছেলের মধ্যে বড় ছেলেকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছি। যদি কর্মসংস্থানের সঠিক তথ্য প্রদান ও দালাল প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে রংপুর থেকে আরও বেশি লোক যেতে আগ্রহী হবে মনে করেন তিনি।
২০০৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে দেশের ১ কোটি ৫ লাখ ৯ হাজার ২০৮ জনের। এরমধ্যে সবচেয়ে কম সংখ্যা রংপুর বিভাগের, মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে, ৩৯ শতাংশ। এরপর ঢাকা বিভাগে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ, সিলেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, খুলনায় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, বরিশালে ৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রচার-প্রচারণা ও দক্ষ শ্রমিকের অভাবের পাশাপাশি উচ্চ ব্যয়ের কারণে অনগ্রসর এই অঞ্চলটিতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। সঙ্গে অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালের দৌরাত্ম্য একটি অন্যতম কারণ। সরকারি উদ্যোগ এবং প্রান্তিক পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরও বৃহৎ কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি দালালের দৌরাত্ম্য দমনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ তাদের।
তিস্তা ইউনিভার্সিটির ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের প্রধান সবুজ সরকার বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার প্রসার করতে হবে। বিদেশে লোকবল পাঠাতে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সহায়তা নিতে হবে। মানুষ যাতে কোনোভাবেই প্রতারিত না হয়, সেজন্য সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে।
তবে দালালের দৌরাত্ম্য ও এজেন্সির অনিয়ম ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কর্তৃপক্ষের। শুধু তাই নয় নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে নানামুখী কার্যক্রম চলছে বলেও জানিয়েছেন রংপুর কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক মো. নেশারুল হক।
তিনি বলেন, অভিবাসনের ক্ষেত্রে দালালদের দৌরাত্ম্য কমানোর পাশাপাশি নিরাপদ, নৈতিক ও মর্যাদাপূর্ণ শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। বিশেষ করে এজেন্সির অনিয়ম ঠেকাতে সরকার সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাতায়ন২৪ডটকম