রংপুর প্রতিনিধি,বাতায়ন২৪ডটকম
উত্তরাঞ্চলের রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নে অবস্থিত শ্যামপুর চিনিকল একসময় দেশের অন্যতম সফল চিনিকল হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই চিনিকলটি শুরু থেকেই এলাকার কৃষক, শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষের জীবনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিল। আখচাষের প্রসারে এই অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
এই চিনিকলে কাজ করতেন সাত হাজারেরও বেশি শ্রমিক-কর্মচারী এবং আখচাষিরা।
তাদের জীবনে পরিবর্তন এনে দিয়েছিল মিলটি। কিন্তু ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর আচমকা মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হলে পুরো এলাকা থমকে যায়। মিল এলাকার পরিবেশ ভূতুড়ে জনপদে পরিণত হয়। কর্মসংস্থান হারিয়ে বিপাকে পড়েন শত শত কর্মচারী ও আখচাষি।
চার বছর পর, চলতি মাসের ১৭ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে শ্যামপুর চিনিকল পুনরায় চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ঘোষণায় কর্মরত কর্মচারী, আখচাষি এবং স্থানীয় মানুষ নতুন আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আফরোজা বেগম পারুল স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীন মাড়াই স্থগিতকৃত চিনিকলগুলো পুনরায় চালুর জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে শ্যামপুর এবং সেতাবগঞ্জ চিনিকল চালু করা হবে।
স্থানীয়দের মতে, এই ঘোষণায় আখচাষে আগ্রহ বৃদ্ধি এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে চার বছর বন্ধ থাকার কারণে আখচাষিরা বিকল্প ফসল চাষে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আখ চাষে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে।
১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর চিনিকলটি একসময় রংপুর অঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। শুরুতে এটি ১০ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করে।
স্বাধীনতার পর এই মিলটি আখচাষে উৎসাহ এবং কৃষকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা আর্থিক সমস্যা, দুর্নীতি, এবং অব্যবস্থাপনার কারণে ১৯৮৫ সাল থেকে মিলটি লোকসানে পড়তে থাকে। ২০২০ সালে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত চিনিকলটির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২২৬ কোটি টাকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, মিলটির অবকাঠামো এখন জরাজীর্ণ। ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে আখ পরিবহনের ট্রাক্টর। যন্ত্রপাতি মরিচায় নষ্ট হয়ে গেছে। শ্রমিকরা বকেয়া বেতন না পেয়ে দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন। তবে মিল চালুর ঘোষণায় তাদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
মিলটি পুনরায় চালু করতে প্রথমে অবকাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। মিলের ইনচার্জ মাসুদ সাদীক জানিয়েছেন, যন্ত্রপাতি পুনরায় কার্যকর করতে এবং আখ রোপণ শুরু করতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আখ চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, হঠকারী সিদ্ধান্তে মিল বন্ধ হওয়ায় আখচাষিরা বিকল্প ফসল চাষে ঝুঁকেছেন। এখন সময়মতো তাদের উৎসাহ দিয়ে আখ রোপণ এবং মিলের সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি।
আখচাষি কল্যাণ কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বলেন, মিল চালানোর জন্য পর্যাপ্ত আখের মজুত থাকা জরুরি। ঘোষণায় আমরা আনন্দিত। এটি আমাদের এলাকায় কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আনবে।
মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান বলেন, মিল চালুর ঘোষণায় আমরা খুশি। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আখ রোপণ এবং মিল সংস্কার করতে হবে।
স্থানীয় জনগণ মিলটির কার্যক্রম পুনরায় শুরু হওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তারা আশা করছেন, এই উদ্যোগ শ্যামপুর চিনিকলকে আবারও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
বাতায়ন২৪ডটকম