সংবাদ শিরোনাম :
ভারতীয় দূতকে তলব, গণমাধ্যমের সঙ্গে হাসিনার কথা বলা বন্ধ করতে বলল ঢাকা অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে করবেন না, ‘রাজপথের সঙ্গীদের’ উদ্দেশে তারেক রহমান নির্বাচন বানচালের জন্য দেশী-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে: নুর আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে এক হাসনাত আব্দুল্লাহই যথেষ্ট বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বিএনপির ওয়ার্ড নেতৃবৃন্দের সাথে এমপি প্রার্থী সামুর নির্বাচনী মতবিনিময় সভা  রংপুরে র‍্যাবের বিশেষ অভিযানে প্রতারক নাজমুল হাসান গ্রেফতার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের বাড়িতে তল্লাশি, আটক ৬ চলতি মাসের শেষ দিকে দেশে ফিরছেন তারেক রহমান অস্ত্রধারীদের দেখামাত্রই ব্রাশফায়ারের নির্দেশ সিএমপির
নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুর পরিচয়-ছবি-ভিডিও প্রকাশ কতটা আইনসঙ্গত? আমরা কতটা সচেতন?

নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুর পরিচয়-ছবি-ভিডিও প্রকাশ কতটা আইনসঙ্গত? আমরা কতটা সচেতন?

 

যৌন নির্যাতনের শিকার (ধর্ষিতা শব্দটি কলঙ্কজনক—তাই ব্যবহার করছি না) নারী বা শিশুর ছবি, ভিডিও ও পরিচয় প্রকাশ কোনোভাবেই আইনসঙ্গত নয়। এটি শুধু অনৈতিক নয়—মানবিকতার পরিপন্থী। কিন্তু দুঃখজনক যে, অনেক গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের সংবেদনশীল তথ্য নির্দ্বিধায় প্রচার করা হচ্ছে।

ঘটনা সত্য হোক বা মিথ্যা—পারিবারিক বিষয় প্রকাশ পেতেই অনেকেই সেটি ‘ভাইরাল করার প্রতিযোগিতায়’ নেমে পড়েন। শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী—কেউই রক্ষা পাচ্ছে না পরিচয় ফাঁসের লজ্জাজনক সংস্কৃতি থেকে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরেও অভিযোগ উঠে আসে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরঞ্জিত হয়ে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

সম্প্রতি গাইবান্ধার বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে—ভুক্তভোগী নারী ও শিশুর নাম, ছবি, এমনকি তাদের বক্তব্য ভিডিও রেকর্ড করে প্রচার করা হয়েছে। “ভিউ” পাওয়ার লোভে কেউ সরাসরি নাম প্রকাশ করছে, আবার কেউ পরিবারের পরিচয় উদ্ধৃত করতে গিয়ে অজান্তেই ভুক্তভোগীকে সনাক্তযোগ্য করে তুলছে। শুধু সাধারণ ব্যবহারকারী নয়, অনেকেই ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ে এসব কপি-পেস্ট করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে।

এছাড়া গত কয়েকদিনে জেলায় প্রেম-পরকীয়া বা বিয়ে দাবিতে ছেলে-মেয়েকে আটক রাখার ঘটনাও আলোড়ন তুলেছে। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এসব ঘটনার খবর আমার কাছেও আসে। কিন্তু অনুসন্ধান শুরু করার আগেই দেখি—ঘটনার খণ্ডচিত্র প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই ছড়িয়ে গেছে। ভিউ বৃদ্ধির আশায় অনেকে ভুক্তভোগীর নাম, পরিচয়, পেশা, ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করছেন। ফেসবুক দেখে অনেকেই আবার সেই তথ্য কপি-পেস্ট করে নিজেদের ফেসবুক পেজ, অনলাইন নিউজ সাইট ও এমনকি প্রিন্ট পত্রিকায় প্রচার করছেন।

কেউ প্রকাশ করছে ভুক্তভোগীর নাম, কেউ মায়ের নাম উল্লেখ করে পরিচয় উন্মোচন করছে। কখনও প্রতিবাদসূচক স্লোগান উদ্ধৃত করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার শিশুকে পর্যন্ত সনাক্তযোগ্য করে ফেলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাম, ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়া—এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং নৈতিকভাবে দণ্ডনীয়। নির্যাতন, প্রতারণা বা সামাজিক চাপে পড়া কাউকে চিহ্নিত করে প্রচার করা যাবে না।

ফলে কেউ ইচ্ছায়, কেউ ভুলে—ভুক্তভোগীর নাম প্রকাশ করছেন, কেউ মায়ের নাম উল্লেখ করে পরিচয় উন্মোচন করছেন, আবার কারও বক্তব্য উদ্ধৃত করার ফলে শিশুর পরিচয়ও প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাম, ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়া—এটি শুধু অগ্রহণযোগ্য নয়, নৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কিন্তু আইন কি বলে? নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ১৪(১) ধারা অনুযায়ী— কোনও নারী বা শিশু নির্যাতনের শিকার হলে তার নাম-ঠিকানা বা সনাক্তযোগ্য তথ্য প্রকাশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড, অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

অর্থাৎ ভুক্তভোগী নয়—প্রকাশ করতে হবে অপরাধীকে। অপরাধীর নাম, ছবি, পরিচয়, অপরাধের পদ্ধতি প্রকাশ করা প্রয়োজন—যাতে সমাজ সতর্ক হয়, সচেতন হয়।

মূলত একটি ঘটনার পর ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ মানে তাকে দ্বিতীয়বার অপমান করা, মানসিকভাবে আঘাত দেওয়া এবং তার নিরাপদ ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথটিকে কঠিন করে তোলা। এটি সামাজিক অবক্ষয়কে আরও গভীর করে।

তাহলে প্রশ্ন—এটি কি সাংবাদিকতা, নাকি সংবেদনশীলতাহীন গসিপ সংস্কৃতি? সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব সত্য তুলে ধরা—কিন্তু তা অবশ্যই নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা ও সংবেদনশীলতা বজায় রেখে করতে হবে। সংবাদের ভাষা হতে হবে সহানুভূতিশীল, বিচারপ্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে উৎসাহদায়ক এবং অপরাধীর প্রতি কঠোর অবস্থানকারী। ভুক্তভোগীকে দোষারোপ বা লজ্জিত করা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।

যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, ভিডিও বা পরিচয় প্রকাশ আইনগত ও নৈতিকভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ; এটি ভুক্তভোগীকে দ্বিতীয়বার শোষণ করা। এই আচরণ শুধু অনৈতিক নয়—এটি ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক ক্ষতি করে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ কেড়ে নেয়।

তাহলে সমাধানের পথ কী? এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসতে প্রথম ধাপ হতে পারে সাংবাদিকদের জন্য ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনের নৈতিকতা ও পেশাগত দিক নিয়ে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ—যাতে ভুক্তভোগীর পরিচয় ফাঁস করলে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তৃতীয়ত, গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে তদারকি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে—যাতে নৈতিকতা শুধু লিখিত নীতিতে নয়, প্রতিদিনের সংবাদচর্চায় প্রতিফলিত হয়।

সুতরাং— সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সমাজের প্রতিটি দায়িত্বশীল মানুষের উচিত—ভুক্তভোগীর পরিচয় গোপন রাখা, ছবি-ভিডিও প্রচার থেকে বিরত থাকা এবং পুনর্বাসনের সুযোগ নিশ্চিত করা।

সবার প্রতি আহ্বান—আসুন, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে জেন্ডার সহিংসতা নির্মূলের জন্য প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জেন্ডারসংবেদনশীল হই।

মূলত সাংবাদিকতা হলো বস্তুনিষ্ঠ সত্য প্রকাশ ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার লড়াই। প্রকৃত সাংবাদিকতার পরিচয়—ভুক্তভোগীকে নয়, অপরাধীকেই প্রকাশ করা। আবার অপরাধীকে লুকানো নয়—ভুক্তভোগীকে রক্ষা করাই সভ্য সমাজের পরিচয়।

— জিল্লুর রহমান পলাশ, গণমাধ্যমকর্মী, গাইবান্ধা। ২৯ অক্টোবর ২০২৫ ইং।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..




© All rights reserved © batayon24
Design & Developed BY ThemesBazar.Com