এবার থানায় স্বশরীরে কৃষক লীগ নেতা উপস্থিত হয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে যোগদানরা এক বিএনপি নেতাকে বাদি বানিয়ে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা নিলেন এক ওসি। ঘটনাটি রংপুরের বদরগঞ্জের। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ। তারা ওসিকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে (২৬ নভেম্বর) এই মামলাটি হয় বদরগঞ্জ থানায়। এসময় ওসি আতিকুর রহমানের রুমে উপস্থিত থেকে বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষকলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেন লাভলু (সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বদরগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ)তার ভাতিজি জামাই বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সদ্য যোগদানকৃত সহ-সভাপতি (একই ওয়ার্ডের সাবেক সহ-সভাপতি, স্বেচ্ছাসেবক লীগ) তোফাজ্জল হোসেনকে বাদী বানিয়ে দৈনিক পরিবেশের বদরগঞ্জ প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান শাহ মনিরকে প্রধান এবং তার পিতা বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন বিএনপি’র সাবেক সভাপতি আব্দুল আজিজের এর নামে এই মামলাটি করেন।
বাদী সাবেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তোফাজ্জল হোসেন একটি মামলার ২ নম্বর আসামি হলেও জামিন না নিয়ে ওই কৃষকলীগ নেতার দাপটে তার সাথে ওসির রুমে গিয়ে মামলাটি রেকর্ড করান। তবে কৌশলে মামলার এজাহার ভাগিনা রবিউল ইসলামের মাধ্যমে থানায় দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি একেএম আতিকুর রহমান, ” কোন কৃষক লীগ নেতা এবং বাদী তোফাজ্জল হোসেন থানায় আসেননি। তোফাজ্জল হোসেন ভাগিনার মাধ্যমে এজাহার দিয়েছেন।”
ওসি অস্বীকার করলেও ঘটনার সময় থানায় উপস্থিত দৈনিক যুগান্তরের প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) রাত ১২টার কিছুটা আগে আমি নিউজ এর কাজে থানায় যাই। তখন দেখি কৃষকলীগ নেতা বেলাল হোসেন লাভলু এবং তোফাজ্জল হোসেন ওসির রুম থেকে বের হচ্ছেন। তারা যখন থানা থেকে বের হয়ে যান তখন থানার সামনে মেনহাজ সংঘের সামনে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। পরে আমি শুনতে পাই সাংবাদিক মনিরের নামে তারা মামলা করে ওসির রুম থেকে বের হলেন। এই ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই।
মামলাটির বিষয়ে রংপুর পুলিশ সুপার আবু সায়েম জানান, “বিষয়টি তার নলেজে ছিল না। এ ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আমিনুল ইসলাম বলেন, ” ২৪ শে জুলাই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের চিহিত নেতারা এলাকাতেই থাকার কথা না। কিন্তু কিভাবে তিনি থানায় গিয়ে প্রভাব বিস্তার করে মামলা রিপোর্ট করালেন। এ ব্যাপারে খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ”
প্রসঙ্গত : গত ২৩ শে নভেম্বর সকালে জমি জমার বিরোধের জেরে সাংবাদিক মনিরুজ্জামান শাহ মনিরের পিতা আব্দুল আজিজ শাহকে বিষ্ণুপুর খাগড়াবন্দ এলাকায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা শওকত আলী ও জামাই সাবেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তোফাজ্জল হোসেন এবং তার লোকজন আটক করে মারধর করেন। এতেনতার মাথায় গুরুতর জখম হয়। এ ঘটনায় শওকত আলী তোফাজ্জল হোসেনসহ অন্যান্যদের নামে থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় জামিন না নিলেও থানায় উপস্থিত হয়ে সাংবাদিক মনির এবং তার বাবার নামে মামলা করেন তোফাজ্জল হোসেন। এ সময় সাথে নিয়ে যান কৃষক লীগ নেতা বেলাল হোসেন লাভলুকে।
সাংবাদিক মনিরুজ্জামান মনির জানান, আমার বাবাকে তারা মেরে রক্তাক্ত করেছে, হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। সেই মামলার কোন আসামিকেই পুলিশ গ্রেফতার করেনি। আওয়ামীলীগ নেতাদের যোগসাজস থাকায় তাদেরকে তিনি গ্রেফতার করেননি। উল্টো ঘটনাটিকে ভিন্নভাবে নিতে ওসি কৃষক লীগ বেলাল হোসেন লাভলু এবং সাবেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তোফাজ্জল হোসেনকে রুমে বসিয়ে আমাকে প্রধান আসামি বানিয়ে বাবা সহ আটজনের নামে মামলা রেকর্ড করলেন। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে যদি একজন থানার ওসি প্রকাশ্যে এই কাজ করেন। তাহলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কোথায়। রাষ্ট্রের কাছে এটা আমার প্রশ্ন। এদিকে সাংবাদিক মনিরুজ্জামান মনিরের বিরুদ্ধে মামলা নেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।
এ ব্যাপারে বদরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি আলতাফ হোসেন দুলাল বলেন, “ওসির রুমে কৃষক লীগ নেতাসহ মামলার আসামি জামিন না নিয়ে উপস্থিত থেকে সাংবাদিকের নামে যে মামলাটি করা হয়েছে। তাতে প্রমাণিত হয় পুলিশ এখনো পুরনো কালচার থেকে ফিরে আসতে পারেনি। এর মাধ্যমে গণমাধ্যমের কন্ঠ রোধ করতে ওসি সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন। এই ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। অবিলম্বে ওসিকে অপসারণ করতে হবে। প্রেসক্লাবে জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে মাঠে নামব আমরা। ”
রংপুর সিটি প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বপন চৌধুরী জানান, “জামিন না হওয়া আসামি কিভাবে থানায় গিয়ে সাংবাদিকের নামে মামলা করলো, এটা আমাদের মাথায় ঢুকে না। পুলিশ কি বাংলাদেশকে মগের মুল্লুক মনে করল। অবিলম্বে ওই ওসিকে অপসারণ করতে হবে। তা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাব আমরা। ”
রংপুর সম্মিলিত সাংবাদিক সমাজের সদস্য সচিব লিয়াকত আলী বাদল জানান, “বদরগঞ্জ থানার ওসি আইনের বাইরে গিয়ে অনেক বড় স্পর্ধা দেখিয়েছেন সাংবাদিকের নামে মামলা নিয়ে। যিনি বাদী তিনি মামলার আসামি হলেও জামিন নেননি। সাথে নিয়ে গেছেন কৃষক লীগ নেতাকে। আসামি কিভাবে ওসির রুমে গিয়ে সদর্পে মামলা করে, তাতেই বোঝা যায় পুলিশ কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই ঘটনায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে অতি অপসারনসহ সাংবাদিকের নামে মামলা প্রত্যাহার করা না হলে আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে রংপুরের সাংবাদিক সমাজ। ”
রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন-আরপিইউজে সভাপতি সালেকুজ্জামান সালেক জানান, “সাংবাদিকের নামে মামলা নিতে বদরগঞ্জের ওসি যে কান্ড ঘটিয়েছেন তাতে প্রমাণিত হয় ওই ওসি সাহেব সরাসরি ফ্যাসিবাদী কাঠামোর সাথে জড়িত। তিনি এখনো পুরনো ফ্যাসিবাদী দখলদারদের তারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন।”
এরকম একজন পুলিশ অফিসার কিভাবে একটি থানার দায়িত্ব পান এই প্রশ্ন রেখে এই সাংবাদিক নেতা বলেন, “বিষয়টি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের এজিএম বৈঠকেও আলোচনা করা হবে। আমরা দেখতে চাই রাষ্ট্র এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার ব্যাপারে কি উদ্যোগ নিবেন।”
সাংবাদিক নেতা সালেক আরো বলেন, ” জুলাই বিপ্লব পরবর্তী জুলাই বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করার জন্য, বিতর্কিত করার জন্য যেসব পুলিশ কর্মকর্তা নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বদরগঞ্জের ওসি তার মধ্যে অন্যতম।” এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি এই সাংবাদিক নেতার।