দেয়াল ঘড়ির মিনিট ও ঘন্টার কাঁটা ঠিক রাত আটটা।হারুন সাহেব আজকে এখনো বাসায় ফেরেননি। সচরাচর এরকমটা কখনোই দেরি করেন না তিনি। মস্তো বড়ো এই শহরের পথগুলো কিছুটা কৃপণ। টোকাইদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। ছিনতাইয়ের খবর হরহামেশাই চোখে পড়ে স্হানীয় পত্র -পত্রিকাগুলোতে। মেট্রোপলিটন পুলিশ নজরদারি বাড়ালেও খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। অপরাধীরা নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে কার্য হাসিল করে। এটা তাদের দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ। আমি কিছুটা চিন্তিত। অনেকটা আমার ওপর ভরসা করেই এই শহরে এসেছেন তিনি। কিছু একটা হয়ে গেলে থানা পুলিশ! এগুলো খুব একটা পছন্দ নয় আমার। দু একজায়গায় খোঁজ নিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে- কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়ে সংশপ্তক পড়তে থাকি আমি। শহীদুল্লা কায়সার এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘সংশপ্তক’। নিয়ম করে একটা উপন্যাস পড়ার অভ্যাস জেঁকে বসেছে আমার। এই উপন্যাসের লেকু চরিত্রটা আমাকে বেশ টানে। বর্তমান সময়ের অনেকেই আর লেকু হতে পারে না। কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার তাগিদে, অনেক মানুষই লেকুর বিপরীত চরিত্রে অবস্থান করেন।
দেয়াল ঘড়ির কাঁটা ঠিক দশটার কথা বলছে। আমি আরও ক্রমশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মানুষটা হারিয়ে গেলো নাতো! আমি আরেকবার মুঠোফোনটা হাতে তুলতেই একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসে।
– প্রফেসর?
আমি দরজা খুললাম। হাতে একটা ডায়েরি আর দু তিনটে বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হারুন সাহেব। আমি কিছুটা চিন্তিত কণ্ঠেই তাকে বললাম,
– হারুন সাহেব, এতো রাত হলো যে?
– আপনাদের ক্যাম্পাসেই ছিলাম। ক্যাম্পাসটা দেখে মনে হলো চলনসই। তবে মাস্টারপ্ল্যানটা খুব একটা সুবিধে মনে হলো না। ভবনগুলো খুউব কাছাকাছি। ডরমেটোরিগুলোও এলোমেলো।
আমি তাকে ফ্রেশ হতে বললাম। টেবিলে খাবার ততক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে।
– হারুন সাহেব, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। তা-না হলে খেতে পারবেন না।
আজকে রাতে কনকনে শীত লাগছে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতো শীত পড়ছে। টিনের চালা হলে নিশ্চয়ই বৃষ্টিই মনে হতো। হারুন সাহেব খেতে বসলেন। আর আমার মন পড়ে থাকে সংশপ্তক এর বইয়ের পৃষ্ঠায়। একটানা পড়তে থাকি আমি। বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ভেসে চলি। এটা আমার কল্পনা নয়। লেখকের কল্পনায় -বাস্তবতার আমি ছবি আঁকি মাত্র।
হারুন সাহেব খাওয়া শেষে একটি পত্রিকা নিয়ে আসলেন আমার কাছে। আমার বাসায় তিন তিনটে পত্রিকা রাখি। সবগুলোই বাংলা। ইংরেজি পত্রিকা রাখার অভ্যেস নেই। ইংরেজি ভাষার প্রতি আমার একটা ধারণা আছে। খুব সম্ভবতই এটা আমার মনের বিরূপ ধারণা। আমার শৈশব ও কৈশোর পর্যন্ত ধারণাটা লালন করি আমি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গণ্ডি টপকাতে বেশ বেগ পেতে হয় আমাকে। ইংরেজি পরীক্ষার খাতার নম্বর ক্রমশ কমতে থাকে আমার। আমার সহপাঠীরা বেশ আনন্দ পেতেন আমার এই ব্যর্থতা দেখে।
– প্রফেসর, একটা সংবাদ দেখেছেন?
– কোন সংবাদটা?
– বিশ্ব র্যাংকিং এ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান একবারে শেষের দিকে।
– দেখেছি। এর জন্য অবশ্য কিছুটা আমরাই দায়ী। আমরা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
-কেনো প্রফেসর?
– আমি প্রায়শই দেখি আমার অনেক সহকর্মীরা নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। সংসার নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টা তাদের কাছে ঐচ্ছিক। সংসারের কাজ সেরে যতটুকু সময় থাকে, বাকিটুকু বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেন তারা।
– প্রফেসর, আপনার কথাও ভুল হচ্ছে। খুব সম্ভবত তারা গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
আমি কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে তাকে বললাম,
-আমি ঠিকই বলছি। অধিকাংশ শিক্ষকরাই গবেষণার প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখান না, যতটা না তাদের পদ আর পদবীর প্রতি আগ্রহ আছে। এদের খুব একটা দক্ষতাও নেই। একাডেমিকের বাইরের জ্ঞান একবারে সীমিত।
আমি হারুন সাহেব কে আরেকটা নতুন তথ্য দিলাম। যেটা শুনে হারুন সাহেব কিছুটা আশ্চর্যই হলেন। আমি তাকে প্রথমেই বললাম,
– আচ্ছা হারুন সাহেব, শিক্ষকদের কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
হারুন সাহেব কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,
– কেউ যদি শিক্ষক হতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে মানুষের উর্ধ্বে হতে হবে!
চলবে……….
Leave a Reply