মাননীয় উপাচার্য স্যারের মেয়াদ শেষের দিকে। বড়োজোর আর কয়েকমাস। দ্বিতীয় মেয়াদে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। পত্র পত্রিকায় উপাচার্য স্যারকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে হরহামেশাই । শিক্ষক নেতাদের পদচারণায় ক্যাম্পাস বেশ উত্তপ্ত। ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর খুব একটা মিছিল মিটিং দেখা যায় না। শিক্ষক নেতাদের মিছিল মিটিং কিংবা কর্মকাণ্ডেই ক্যাম্পাস প্রায়ই সড়গড়ম থাকে। খুব সম্ভবত আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যার চেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলের সংখ্যা অনেক বেশি।
আমার বিভাগে মোট আটজন শিক্ষক। দুজন অধ্যাপক, তিনজন সহযোগী অধ্যাপক, দুজন সহকারী অধ্যাপক, একজন প্রভাষক। আমিও অধ্যাপনা করি। পদমর্যাদায় আমি ছোটো অধ্যাপক।
আমার বিভাগের দুজন অধ্যাপকই উপাচার্য হওয়ার আশায় ঢাকায় পড়ে থাকেন প্রায়শই। তাদের রুমের তালাগুলোয় ময়লা জমেছে। আমার রুমের পাশেই তাদের রুম। দুটো রুমের দরজায় ঝুলে থাকা তালা দুটোতে প্রায়শই হাত বুলাই আমি। বেশ ময়লা লেগে থাকে হাতে। বিভাগের অনেক শিক্ষার্থীরাই আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেকটা আগ্রহ নিয়ে ঢাকায় পড়ে থাকা শিক্ষকদের সম্পর্কে জানতে চান। আমি কিছুটা সান্ত্বনা দিয়ে আশার বাণী শুনিয়ে দেই- খুউব শিগগিরই স্যাররা অসমাপ্ত কোর্সগুলো সমাপ্ত করবেন।
একদিন এক শিক্ষার্থী আমার রুমে এসে অঝোরে কান্না শুরু করলেন। আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম । জানতে পারলাম তার কষ্টের দীর্ঘ একটা পথ আছে। যে পথের দৈর্ঘ্যটা আরও দিনদিন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সেদিন আমাকে সে বললেন,
– স্যার, খুউব ইচ্ছে ছিলো আমার বাবা যেনো আমার একটা চাকরি দেখে যেতে পারেন! এখন মনে হচ্ছে আমার বাবা আমার স্নাতকের সার্টিফিকেটাও দেখে যেতে পারবেন না!
সত্যি তাই। তার বাবা তার স্নাতকের সার্টিফিকেটা দেখে যেতে পারেননি। কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিলো- বাংলা বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীর পিতার মৃত্যুতে বাংলা বিভাগ গভীরভাবে শোকাহত!
তার বাবা চলে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর একদিন তাকে ডেকে পাঠালাম আমার রুমে। তাকে বললাম,
– বাবার সাথে শেষ কী কথা হয়েছিল আপনার ?
সে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললেন,
-আমাকে ক্ষমা করো বাবা!স্যারদের ব্যস্ততার কারণে, তোমার স্নেহ আর ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারলাম না আমি!
কথাগুলো শেষ করতে না করতেই হুহু করে কান্না শুরু করলেন তিনি। আমিও আর সেদিন তাকে থামালাম না।মনে মনে ভাবলাম- ছেলেটা মন খুলে কাঁদুক। কখনো কখনো মন খুলে কাঁদলে, জীবনের দুঃখগুলো অনেকটা হালকা হয়ে আসে।
বাংলা বিভাগ থেকে রিচার্স জার্নাল প্রকাশিত হবে এ বছর। বিভাগীয় প্রধান স্যার সম্পাদনার দায়িত্বটা আমার কাঁধেই অর্পণ করেছেন। প্রকাশনার সুবাদে শহরে প্রায়ই যেতে হয় আমাকে। এখানকার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো মূল শহরে গড়ে ওঠেছে। আজকেও শহরে গিয়ে জাহিদ ভাইয়ের সাথে দেখা। আজকের পোশাকে জাহিদ ভাইকে চিনতে পারাটা বেশ কষ্টই হচ্ছিলো আমার। লোকটাকে ক্যাম্পাসে প্রায়ই হালকা পাতলা পোশাকে, রঙ বেরঙের পাঞ্জাবি, কখনো টিশার্ট, কখনো শার্ট গায়ে দেখা যায়। আজকে তাকে দেখা মাত্রই সালাম দিয়ে বললাম,
– জাহিদ ভাই, শহরে কী জন্য?
জাহিদ ভাই হাসি মুখে আমাকে জানালেন,
– ছেলেকে স্কুলে নিয়ে এসেছি ভাই! ছুটি হলে একসাথেই ফিরবো।
জাহিদ ভাই ভাবিকে ছাড়া কখনোই একা একাই বাইরে বের হননা । আজকে ভাবিকে পাশে দেখতে না পেয়ে জাহিদ ভাইকে বললাম,
– জাহিদ ভাই, আজকে কি ভাবিকে রেখে এসেছেন?
লোকটা আমার কথা শুনে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,
– শরীরটা ভালো নেই আজকে আপনার ভাবির। তাই আজকে আর বাইরে বের হলো না।
আমি তার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুটা আন্দাজ করলাম, জাহিদ ভাই নিশ্চয়ই আজকে আমার কাছে কিছু লুকচ্ছে। পাশেই চায়ের দোকানে দু কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম আমি। জাহিদ ভাইয়ের প্রিয় দুধ চা, আর আমার লাল চা। চায়ের চুমুকে চুমুকে আমাদের খানিক সময় গল্প হলো। জাহিদ ভাই জানালেন, তার ছেলে পড়ালেখায় খুব একটা আগ্রহী নয়। তাকে মোটেও ভয় পায় না, যতটা না তার মাকে ভয় পায়। জাহিদ ভাই এটাও জানালেন, প্রত্যকেটা বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা তার ছেলের গৃহ শিক্ষক আছেন।
কাপের চা শেষ হতে না হতেই তার ছেলে এসে হাজির। ওর নাম অংকন। এর আগেও অংকন এর সাথে আমার অনেকবার কথা হয়েছে। কথা বলে যেটা মনে হয়েছে, পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ার ফলে অংকনকে অনেক শাস্তি পেতে হয় । আমি জাহিদ ভাইকে বললাম,
– জাহিদ ভাই, অংকনকে একটা ভালো ডাক্তার দেখায়েন। আমার ধারণা অংকন পড়াশোনায় মনযোগী হয়ে উঠবে।
জাহিদ ভাই মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আমিও আজকে জাহিদ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। জাহিদ ভাইকে কিছুটা ছেড়ে আসতেই অংকন বলে উঠলো,
– আব্বু , আম্মুর আজকে এখনো শপিং করা শেষ হয়নি!
আমি অংকনের কথা শুনতে পেয়েও আর পেছনে তাকালাম না। ভাবলাম জাহিদ ভাই নিশ্চয়ই লজ্জা পাবেন। একটা রিক্সা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে পথ ধরলাম। আরও দুটো ক্লাস নিতে হবে আমাকে।রিক্সায় আসতে আসতে ভাবতে লাগলাম- আমরাও কি মস্তো বড়ো চোর নই?
চলবে……
Leave a Reply