দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা ছবি তিনটে একটু উঁচুনিচু অবস্থানে। ছবি তিনটে এরকমটা কখনোই ছিলো না। একই সারিতে টাঙিয়ে রেখেছিলাম আমি। ধূলো- ময়লায় মিশে থাকা ছবি তিনটে নতুন ছবির মতোই জ্বলজ্বল করছে । হারুন সাহেব আমার দিকে এগিয়ে আসে। কিছুটা ল্যাংড়িয়ে ল্যাংড়িয়ে হিসেব করে পা ফেলছে আজ। হারুন সাহেব কিছুটা কাতরকণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-কখন ফিরলেন প্রফেসর?
আমি চিন্তিত কণ্ঠে উত্তর দিলাম,
-মিনিট বিশেক হবে!
হারুন সাহেবের বাম পায়ের আঙ্গুলগুলো ফুলে উঠেছে। হয়তো রিক্সা থেকে পড়ে গিয়েছে, কিংবা কোথাও হোঁচট খেয়েছে। এটা অবশ্য আমার আনুমানিক। অনুমান সবসময় ঠিক নাও হতে পারে। তবে কাছাকাছি হওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। আমি খেয়াল করি হারুন সাহেবের অনুসন্ধিৎসু দুটো চোখ দেয়ালে লেপ্টে থাকা ছবি তিনটের দিকে। আমি প্রশ্নাতুর কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-হারুন সাহেব, চেনেন এনাদের?
মানুষটার মুখে আজ রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। এই শব্দহীন হাসি আমাকে মাঝে মাঝে অনেককিছুই ভাবিয়ে তোলে। দু একটা নামী দামি বিশ্ববিদ্যায়ের সনদ থাকলে মানুষটা জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পারতো। ধারণাটা অবশ্য একান্তই আমার ব্যক্তিগত। তবে সমাজের চিত্র আমার ধারণার পুরোটাই বিপরীত। হারুন সাহেবের একটা জগৎ আছে। যে জগৎটা একজন থেকে আরেকজনকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। হারুন সাহেবের সে জগতের সীমানার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ কতদূর এখনো আমার জানা হয়ে ওঠেনি। হয়তো একদিন হবে। সে জগৎটা খুব সম্ভবত আমার থেকে অনেক দূরে। খানিক সময় নিয়ে হারুন সাহেব বললেন,
-সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল!
হারুন সাহেব প্লেটোর ‘দি রিপাবলিক’, অ্যারিস্টটলের ‘দ্যা পলিটিক্স’ গ্রন্থ সম্পর্কে আমার কাছে সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন। তিনি এটাও জানালেন, সক্রেটিস কোনো বই লেখেননি। সক্রেটিস সম্পর্কে আমরা যতদূর জানি তা পুরোটাই প্লেটোর লেখা থেকে।
-আচ্ছা হারুন সাহেব, আপনি প্লেটোর দর্শন পড়েছেন?
-জ্বি পড়েছি! তবে পড়ে আমি যেটা বুঝেছি দর্শন পড়ার জিনিস নয়। দর্শন ধারণ করার জিনিস। দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে মতবাদ। আমরা মতবাদে বিশ্বাসি। পৃথিবীর অধিকাংশ দার্শনিকরা নাস্তিকতা মতবাদের সাথে সহমত পোষণ করেন। দু একজন ব্যতিত। দর্শন চর্চা এখন আর তেমন দেখা যায় না। কেননা দর্শনের ভিত্তি বেশ নড়বড়ে। দর্শনের গ্রহণযোগ্যাতাও হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।
আমি কিছুটা মাথা নেড়ে সায় দিলাম। সত্যি তাই। আমাদের দেশে নতুন করে আর দার্শনিক হয়ে ওঠে না কেউ। দু একজন দার্শনিক হলেও এদেশে অবস্থান করেন না। তারা সীমানা পেড়িয়ে অন্যত্র অবস্থান নেয়।সেখানে তাদের চাহিদা আকাশচুম্বী ।
হারুন সাহেব আজকে একটা নতুন তথ্য জানালেন আমাকে। সে গবেষণা করে মানুষের প্রকারভেদ চিহ্নিত করেছেন। তারমতে পৃথিবীতে তিন প্রকার মানুষ আছে। এক, ভালো মানুষ। দুই, খারাপ মানুষ। তিন, অবস্হানভেদে ভালো ও খারাপ মানুষ। পৃথিবীতে অবস্থানভেদে ভালো ও খারাপ মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরা পৃথিবীর বেশি ক্ষতি করে থাকেন। সময়ে সময়ে এরা রঙ বদলান। হারুন সাহেবের আজকের কথাগুলো আমার বেশ মনে ধরে। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই, আমিও মানুষ নিয়েই গবেষণা করবো। এক্ষেত্রে হারুন সাহেবের তথ্যগুলো, আমাকে গবেষণার কাজে অনেকখানি এগিয়ে রাখবে।
পেটে ক’বার ডাক পড়েছে। দুপুরের খাবারটা বাইরে খেলেও খুব একটা মন্দ হতো না। আজকে আমার বিভাগের এক শিক্ষার্থী আমার জন্য রান্না করে তরকারি পাঠিয়েছেন। হারুন সাহেব আজকে রোজা নেই। আমি আর হারুন সাহেব একসাথেই খেতে বসলাম। হারুন সাহেবের প্লেটে দুটো মাছের টুকরো দিয়ে বললাম,
-হারুন সাহেব, আমার এক শিক্ষার্থী তাদের পুকুরের ইলিশ মাছের তরকারি পাঠিয়েছেন!
হারুন সাহেব আমার কথা শুনে কিছুটা হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। সামনে গ্লাস ভর্তি পানি নিমিষেই শেষ করে ফেলে। আমিও কিছুটা বিনয়ের সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
– হারুন সাহেব, খাচ্ছেন না যে?
হারুন সাহেব আমাকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করলেন- আমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি মৃদু হেসে বললাম,
– নাহ! ইলিশ মাছ পুকুরেও হয়!
চলবে……
Leave a Reply