•হাসান আলী
ছাত্রলীগ দেশের ক্যাম্পাস গুলোতে র্যাগিং ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে পদযাত্রা, সমাবেশ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি করেছে আজ। পদযাত্রাটি আজ সকাল ১১টায় মধুর ক্যান্টিন থেকে শুরু হয়ে রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। তবে সম্প্রতি ঘটা শিক্ষার্থী নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীরা জড়িত থাকলেও এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিয়ে এমন কর্মসূচী ঘোষণা করা তাদের একপ্রকার রাজনৈতিক ‘স্ট্যান্ডবাজি’ মনে করছেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা। এই ‘স্ট্যান্ডবাজি’ দেশের অনেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা বলেও মনে করেন তারা। তবে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এই কর্মসূচিকে স্বাগতও জানিয়েছেন অনেকে।
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনার মধ্যে ইবি, রাবি ও ইডেন কলেজের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) গত ১২ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা হলের গণরুমে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন। শাখা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরার নেতৃত্বে ভুক্তভোগীর সিনিয়র তাবাসসুমসহ ছাত্রলীগ নেত্রীরা রাতভর ওই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, এলোপাথাড়ি চড়থাপ্পড় ও ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করানোসহ নানাভাবে নির্যাতন করেন। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত সেটি দেয়া হয়নি। এ ছাড়াও অভিযুক্ত নেত্রীকে দল থেকে মৌখিকভাবে সাময়িক বহিষ্কার করা হলেও লিখিত কোন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
একই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে কৃষ্ণ রায় নামের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম আলী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোলাইমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এসময় তাকে হত্যা করে ‘শিবির’ বলে চালিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। এ ঘটনায়ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘটনার সাত দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের তিন কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্যে বলা হলেও নির্ধারিত সময় পার হওয়া সত্বেও তাদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।
একইভাবে গত ২১ ফেব্রুয়ারী ইডেন মহিলা কলেজে এক শিক্ষার্থীকে খারাপ আচরণের প্রতিবাদ করায় মারধর, স্ট্যাম্প দিয়ে নির্যাতন, চুল ছিড়ে ফেলা ও বটি নিয়ে ধাওয়ার অভিযোগ ওঠে কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রোকসানার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কলেজ প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে প্রশাসন উভয়পক্ষকে ডেকে মীমাংসা করে দেয়। তবে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ইডেন মহিলা কলেজে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। গত শনিবার এ নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘মীমাংসাতেই ঢেকে যায় অপরাধ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাতে গত কয়েকমাসে কলেজটিতে পাঁচটিরও বেশি ছাত্রীদের মানসিক, শারিরীক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়। একইসাথে ঘটনা গুলোয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা না নেয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়। একটি ঘটনায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রীকে বহিষ্কার করা হলেও পরবর্তীতে সেই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া হয়।
উপরের ঘটনাগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার সূযোগ থাকলেও ছাত্রলীগের নিষ্প্রভ থাকা এবং ক্যাম্পাসে র্যাগিং এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে পদযাত্রার কর্মসূচিকে স্ট্যান্ডবাজি মনে করছেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালমান সিদ্দিক বলেন, আমরা দেখি বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় শারিরীক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এগুলো ছাত্রলীগের এক ধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার। এগুলোর মাধ্যমে ভীতি সৃষ্টি করে তারা তাদের ত্রাসের রাজত্ব স্থায়ী করার চেষ্টা করে। নির্যাতনের ঘটনাগুলোয় ছাত্রলীগ কোন সাংগঠনিক ব্যবস্থা তো নিচ্ছেই না উল্টো এসব ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের দিকে আঙ্গুল তুলতে না পারে, বিষয়টিকে ঘুড়িয়ে দেয়ার জন্য একটা স্ট্যান্ডবাজির অংশ হিসেবে আগামীকালের (আজকের) প্রোগ্রামটি তারা করছে।
ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ছাত্রলীগ তাদের নিজের সংগঠনকেই এখনো নিপীড়ক মুক্ত না করে এর বিরুদ্ধে সচেতনতামুলক কর্মসূচী দিচ্ছে, এটা খুবই হাস্যকর। তারা নিজেদের স্মার্ট প্রমাণ করার চেষ্টা করছে এবং র্যাগিং এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে তারা, এটা বোঝাতে চাচ্ছে। অথচ তাদের সেই কর্মসূচীতেই কিন্তু গেস্টরুমে র্যাগিং ও নির্যাতনের মধ্য দিয়েই হল থেকে সাধারন শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হবে। যেটার বিরুদ্ধে কর্মসূচি সেটার মধ্য দিয়েই কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ার মতো হাস্যকর বিষয় আর কিছু হতে পারে না।
ছাত্রদলের ঢাবি সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল বলেন, যেখানে ক্যাম্পাসগুলোতে নির্যাতনের ঘটনার সাথে তারাই জড়িত সেখানে তারাই আবার এর প্রতিবাদে মাঠে নামছে। এটা হচ্ছে মাঠে মেরে কচু বুঝানো। তাদের দ্বারাই সংঘঠিত এইসব ঘটনা যখন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীর নজরে আসছে তখন এটা থেকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্যেই সম্ভবত তারা এমনটা করছে।
ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, এই বিষয়টা অনেকটা জং ধরা লোহায় রং করার মতো। লোহাকে ভেতর থেকে সংস্থার না করে রং করলে আসলে কিছুই হয় না। আমরা ছাত্রলীগের এই কর্মসূচীকে ভালো উদ্যোগ হিসেবে দেখছি। যদি এই কর্মসূচির মুল কথাগুলো তৃণমূল পর্যায়ে চলে যায় এবং তারা নির্যাতনের কর্ম গুলো থেকে বিরত থাকে তাহলে এটা অবশ্যই ভালো।
সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিয়ে এরকম কর্মসূচী করার ব্যপারে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, এটা একটি সময়োপযোগী কর্মসূচি ও ছাত্র সমাজের চাওয়া এবং প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, এখানে ছাত্র রাজনীতির সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের জবাবদিহিতা রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কলেজ, হল প্রশাসনেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। র্যাগিংয়ের নাম করে শিক্ষার্থীদের যে মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটছে এসব ঘটনায় দ্রুত কলেজ গুলোকে আমরা ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।
ইবি ও রাবির ঘটনায় ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটির সময় পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদন জমা না দেয়ার ব্যপারে তিনি বলেন, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা তাতে বিচার বিভাগ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসনও থেকেও কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি গুলো রিপোর্ট দেয়ার পরপরই আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।
Leave a Reply