-আপনি অনেক সৎ মানুষ!
– কি করে বুঝলেন?
– আপনার শত্রুতা বেশি । সৎ মানুষের শত্রু বেশি । কথাটা বলেই একটা হাসির রেখে ফুটে ওঠে । হাসিটা কমতে কমতে ঠোঁটের প্রান্তে মিশে যায় । মানুষটাকে নিয়ে সন্দেহ জাগে আমার । তবে সন্দেহের মাত্রাটা কমে যায় । পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সে । মুখভর্তি দাড়ি । কোনো কোনো রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে । সপ্তাহে সাতদিনের চারদিনই রোজা রাখে । আজ রবিবার । একদিন পর পর রোজা রাখে সে ।
– আচ্ছা আপনি কি কামাখ্যা গিয়েছিলেন?
– কোন কামাখ্যা একটু যদি বলতেন ।
আমি থেমে গেলাম । ভাবলাম তার এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই । শিক্ষার কথা জিজ্ঞেস করলেও বলে দু বার মেট্রিক দিয়েও পাশের চৌকাঠ অতিক্রম করতে পারেনি । সে সম্ভবত সমাজে ব্যর্থ মানুষ । অবিবাহিত । বয়স পঞ্চাশ এর কাছাকাছি ।
মাঝে মাঝে দু একটা ইংরেজি শব্দ বলে । শব্দগুলোর অর্থ খুঁজতে ডিকশনারি দেখতে হয় আমাকে ।
– আচ্ছা হারুন সাহেব, আপনার জ্যোতিবিদ্যা নিয়ে কোনো ধারণা আছে? এই ধরুন হ্যালির ধুমকেতু । চন্দ্র গ্রহণ, সূর্য গ্রহণ ।
– হুম ! একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে থেমে যায় হারুন সাহেব ! লোকটির বৈশিষ্ট্যগুলো ভিন্ন রকম । দুইকে তিন বলে । সংখ্যা গণনার সময় সবসময় নয় বাদ দিয়ে দশ গোনে ! হারুন সাহেব মানুষ নিয়ে গবেষণা করতে চায় ! মানুষের ক্রমবিকাশ, উৎপত্তি এগুলো নয়, এগুলো নিয়ে বিজ্ঞানাীরা অনেক আগেই গবেষণা করেছেন । তার গবেষণার প্রধান আলোচ্য বিষয় মানুষ ! আমার ধারণা এবং কি আমি বিশ্বাস করি মানুষ সবার সেরা । এটা নিয়ে অবশ্য হারুন সাহেবের কোনো দ্বিমত নেই । হারুন সাহেবের কথার মাঝে কেমন জানি একটা গভীরতা খুঁজে পাই । সচরাচর এই গভীরতা খুব কম সংখ্যক মানুষের মাঝে দেখেছি আমি । সে আমাকে মানুষ আর বন্য প্রাণীর মধ্যে একটা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দেয় । যেখান বন্য প্রাণীর গ্রহণযোগ্যতা ঢের বেশি ।
– আচ্ছা হারুন সাহেব, আপনি লালন সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন !
– মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি ।
– গানটি তো লালনের !
– জ্বি লালনের । লালনের আখড়ায় ক’বছর থেকেছি আমি !
হারুন সাহেব আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় । একটি নব প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করি আমি । নব বলছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স দশ পনেরো । একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌবন শুরু হয় বিশ এর পর । তারপর গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা প্রশাখা । হারুন সাহেব আমাকে প্রায়শই প্রফেসর বলে ডাকে ।
আমি একদিন হারুন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম , আচ্ছা হারুন সাহেব বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আপনার ধারণা কী ? মানুষটা কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দেয়, যেখানে বিশ্বের বই পড়ানো হয় ! হারুন সাহেব কথাটা শেষ করতে না করতেই আরও বলে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট হওয়ার স্থান । হারুন সাহেব এর প্রথম কথার সাথে আমার কোনো দ্বিমত না থাকলেও, দ্বিতীয় কথাটি আমাকে কিছুটা ভাবালো । আমি কিছুটা মৃদু স্বরে হারুন সাহেবকে বললাম, আপনার এরকমটা মনে হওয়ার কারণ কী ? হারুন সাহেব যে উত্তরটা আমাকে দিলে সেটা শুনে আমি কিছুটা ভরকে গেলাম । তার মতে, পৃথিবীর অধিকাংশ দুর্নীতিবাজরাই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ।
হারুন সাহেব কথা থেকে জেনেছে তা আমার জানা নেই । তবে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিতরাই যে দুর্নীতির সাথে জড়িত তা হরহামেশাই পত্র পত্রিকায় দেখা মেলে । হারুন সাহেব এর কথাগুলো নিয়ে সেদিন রাতে ভাবতে থাকি । আর মনে পড়ে আমার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা বড়ো হয়ে কি হতে চাও । সবাই গতানুগতিক একই স্বপ্নের কথা বলেছিলো । তাদের মধ্যে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সংখ্যা ছিল খুব বেশি । দুজনের একজন মানুষ হতে চেয়েছিল । আর অন্য ক’জন তাদের লক্ষ্য এখনও ঠিক করেনি ।
চলবে……
Leave a Reply